বুধবার

গাভীর ওলান শক্ত হলে করণীয় ও চিকিৎসা

গাভীর ওলান ফোলা রোগের ওষুধ ও চিকিৎসা


এখানে যা থাকছে---

  • গাভীর ওলান শক্ত হলে করণীয়
  • গাভীর ওলান ফোলা রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ
  • গরুর ওলান বা বাটের যত্ন
  • গরুর ওলান পাকা রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা

গাভীর ওলান শক্ত হলে করণীয়, গাভীর ওলান ফোলা রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ, গরুর ওলান বা বাটের যত্ন, গরুর ওলান পাকা রোগের প্রাকৃতিক চিকিৎসা
গাভীর ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহ


গাভীর ওলান শক্ত বা ফোলার কারণঃ

সাধারন্ত দুধ উৎপাদন কালীন গাভী বা গরুর ওলান পাকা বা ওলান ফোলা বা ওলান শক্ত হওয়া রোগ দেখা দেয়। ওলান শক্ত হওয়া রোগ কে ইংরেজিতে ম্যাস্টাইটিস (Mastitis) রোগ বলা হয়ে থাকে। ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহ রোগের অন্যতম কারণ একধরণের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া। ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার সাথে ক্ষতিকারক ছত্রাক বা ফাংগাস গাভীর ওলান প্রদাহের জন্য দায়ী। সাধারণত অপরিষ্কার ও ছ্যাঁতছেতে পরিবেশে গাভীর বাটের সরু ছিদ্র দিয়ে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস বা জীবাণু  ওলানে প্রবেশ করে ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহ রোগ সৃষ্টি করে। অপরিষ্কার পরিবেশে যখন গাভী মেঝেতে শুয়ে থাকে তখন গাভীর ওলান বা বাট মেঝেতে পড়ার পর মেঝে থেকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া বাটের সরু ছিদ্র দিয়ে ওলানে প্রবেশ করে ওলানের টিস্যুতে আক্রমণ করে টিস্যু নষ্ট করে দিতে থাকে ফলে ওলানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে পড়ে এবং ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহ বা ওলান শক্ত হওয়া রোগ দেখা দেয়।



ওলান ফোলা রোগের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণঃ

ওলান ফোলা রোগ কে ভিন্নভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে যেমন, ওলান পাকা, উলান ফোলা, ওলান শক্ত হওয়া, ওলান প্রদাহ, ওলান ব্যথা, ওলান পচা, বাট পচা, ম্যাস্টাইটিস ইত্যাদি।



গাভীর ওলান শক্ত বা প্রদাহ হওয়ার লক্ষণঃ

গাভীর ওলান প্রদাহ বা ম্যাস্টাইটিস রোগের লক্ষণ গুলো নিম্নরূপ-

  • ১. ওলান বা বাট ফুলে ওঠে বা শক্ত হয়ে পড়ে।
  • ২. এক বা একাধিক বাট শক্ত হওয়ার পাশাপাশি বাটে লালচে দাগ দেখা দিতে পারে।
  • ৩. গাভীর বাটে হাত দিলে গাভী লাথি দেয় ও সরে দাঁড়ায়।
  • ৪. গরু দুধ দোহনের সময় লাথি দেয় বা বিরক্ত করে।
  • ৫. গাভীর দুধের রং গাঢ় হলুদ বা লালচে বা পুজ রং এর হয়ে ওঠে অনেক সময় দুধে দুর্গন্ধ দেখা দেয়।
  • ৬. দুধের সাথে রক্ত দেখা দিতে পারে।
  • ৭. গাভী বাছুর কে দুধ পান করাতে বিরক্ত বোধ করে বা অস্বীকৃতি জানায়।
  • ৮. দুধ উৎপাদন দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
  • ৯. রোগের মারাত্মক অবস্থায় ওলানে বা বাটে ঘা বা ক্ষত দেখা দেয় এমনকি পচন দেখা দিতে পারে বা সম্পূর্ণ ওলান পচে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  • ১০. গাভীর ওলানে এমনকি শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং খাদ্যগ্রহণ কমিয়ে দিতে পারে।



গাভীর ওলান শক্ত হওয়া রোগের চিকিৎসাঃ

গাভীর ওলান প্রদাহ বা শক্ত হওয়া বা ম্যাস্টাইটিস রোগ খুবি মারাত্মক ও প্রাণঘাতী একটি রোগ। দ্রুত চিকিৎসা না করালে গাভীর বাট বা ওলান আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে পচে যেতে পারে এমনকি গরু মারাও যেতে পারে। দুগ্ধ খামারে ম্যাস্টাইটিস রোগ দেখা দিলে ফার্মের দুধ উৎপাদন কমে যাওয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খামার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ম্যাস্টাইটিস রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি নিম্নরূপ-

  • ১. Oxytocin ইঞ্জেকশন, যেমন - Oxin - ৫-১০ মিলি দিনে ১ বার করে ২-৩ দিন মাংসে প্রয়োগ করতে হবে, প্রয়োজনে রোগ কমা না পর্যন্ত Oxin প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • ২. Dexamethasone Sodium Phosphate জাতীয় ইঞ্জেকশন, যেমন- Dexavet - ওষুধের গায়ে বা লেবেলে থাকা মাত্রা বা নির্দেশ অমুযায়ী প্রয়োগ করে যেতে হবে।
  • ৩. Streptomycin & Penicillin জাতীয় ইঞ্জেকশন, যেমন - SP-Vet,  ২.৫-৫ গ্রাম করে দিনে ২ বার মাংসে প্রয়োগ করতে হবে রোগ না সারা পর্যন্ত।
  • ৪. Masticare Plus পাওডার - লেবেলের নির্দেশ মত বা ওষুধের গায়ে থাকা নির্দেশ মত দিনে ১ বার করে সর্বোচ্চ মাত্রায় ১০ দিন খাওয়াতে হবে।

উপরোক্ত চিকিৎসা পদ্ধিতির পরিবর্তে নিচের পদ্ধতিতেও চিকিৎসা গ্রহণ করা যেতে পারে-

  • ১. Cefixon ইঞ্জেকশন ৫০ কেজি ওজনের গাভীর জন্য ১গ্রাম করে দিনে ১ বার করে ৩-৫ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
  • ২. Pheniravet - ৫০ কেজি ওজনের গাভীর জন্য ৫ মিলি দিনে ১ বার করে ৩ দিন। 
  • ৩. Keto-a vet - ৫০ কেজি ওজনের গাভীর জন্য ৫ মিলি দিনে ১ বার করে ৩ দিন।
  • ৪. Masticare Plus পাওডার - লেবেলের নির্দেশ মত বা ওষুধের গায়ে থাকা নির্দেশ মত দিনে ১ বার করে সর্বোচ্চ মাত্রায় ১০ দিন খাওয়াতে হবে।



গর্ভবতী গাভীর ম্যাস্টাইটিস বা ওলান পাকা রোগের চিকিৎসাঃ

  • ১. Masticare Plus পাওডার - লেবেলের নির্দেশ মত বা ওষুধের গায়ে থাকা নির্দেশ মত দিনে ১ বার করে সর্বোচ্চ মাত্রায় ১০ দিন খাওয়াতে হবে।
  • ২. Dellergen-Vet ইঞ্জেকশন - ওষুধের গায়ে বা লেবেলে থাকা মাত্রা বা নির্দেশ অমুযায়ী ৩-৫ দিন প্রয়োগ করতে হবে।
  • ৩. গর্ভবতী গাভীর সহনশীল উন্নত মানের এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন যেমন- Renasef vet 2gm ইঞ্জেকশন দিনে একবার করে ৩-৫ দিন লেবেলে লেখা নির্দেশ মতো প্রয়োগ করা যেতে পারে।



ঘরোয়া উপায়ে গাভীর ওলান ফোলা রোগের প্রাকৃতিক বা ভেষজ ওষুধ ও চিকিৎসাঃ

  • ১. প্রথমে ১২৫ গ্রাম এলোভেরা বা ঘৃতকুমারী, ২৫ গ্রাম হলুদ গুড়া, ৮ গ্রাম ক্যালসিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা লাইম একসাথে মিশিয়ে অর্থাৎ ১২৫:২৫:৮ এই অনুপাতে নিয়ে সামান্য পানি দিয়ে ব্লেন্ডার মেশিনে অথবা পাটায় বেটে ভালো করে তরল পেস্ট বা হালকা ও তরল কাদাকাদা মিহি করে নিতে হবে।
  • ২. এরপর গাভীর ওলান পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ওলানের সমস্ত বাটের সম্পূর্ণ দুধ দোহন করে উপরের বাটা মিশ্রণ বা পেস্ট ভালো করে সমস্ত ওলানে মাখিয়ে দিতে হবে।
  • ৩. প্রতিদিন ৮-১০ বার একই ভাবে মিশ্রণ তৈরি করে দিনে ৮-১০ বার ওলানে তা ভালো করে লাগাতে হবে।
  • ৪. প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বা দিনের শেষে পেস্ট বা মিশ্রণ তৈরীর সময় পানি না দিয়ে পানির পরিবর্তে সরিষার তেল মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে নিয়ে তা ওলানে ভালো করে লাগাতে হবে।
  • ৫. বাসি পেস্ট ওলানে লাগানো যাবে না এবং প্রতিদিন ৮-১০ বার করে কমপক্ষে ৫ দিন এই পেস্ট বা মিশ্রণ বা ওষুধ ব্যবহার করলে আশা করা যায় গাভী ওলান পাকা বা ওলান শক্ত হওয়া অর্থাৎ ম্যাস্টাইটিস রোগ থেকে গাভী মুক্তি লাভ করবে।



গাভীর ওলান শক্ত হওয়া বা ফোলার সহ চিকিৎসাঃ

উপরোক্ত চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি গাভীর ওলান পাকা বা ম্যাস্টাইটিস রোগ মুক্তির জন্য নিম্নোক্ত সহ চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে-

  • ১. ওলানে থাকা সম্পূর্ণ দুধ দোহন করতে হবে প্রয়োজনে দুধ দোহনের জন্য মিল্ক সাইফন নামক যন্ত্র দিয়ে সম্পূর্ণ দুধ দোহন করে ফেলতে হবে।
  • ২. দুধ দোহনের আগে বাট ভালো ভাবে ধুইয়ে নিতে হবে এবং দোহন শেষে বাটে জীবাণুনাশক যেমন, Povidon লাগাতে হবে।
  • ৩. একটি কাপড়ের টোপলায় বরফ বেধে দিনে ৪-৫ বার ওলান বা বাটের ফোলা স্থানে লাগাতে হবে বা বরফ দিয়ে ছেকে দিতে হবে।
  • ৪. কুসুম গরম বা হালকা গরম জলে ম্যাগসালফ মিশিয়ে গাভীর ওলান বা বাটে সেক দেওয়া যেতে পারে।



গাভীর ওলান ফোলা বা শক্ত হওয়া প্রতিরোধে করণীয়ঃ

  • ১. খামারে কোনো গাভীর ওলান প্রদাহ বা ফুলা দেখা দেওয়া মাত্র চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
  • ২. রোগাক্রান্ত গাভীকে অন্যান্য গরু থেকে পৃথক রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • ৩. সমস্ত সুস্থ গাভীর দুধ দোহন শেষ হলে তবেই রোগাক্রান্ত গাভীর দুধ দোহন করতে হবে।
  • ৪. প্রতিবার দুধ দোহনের আগে দোহনকারীর হাত সাবান বা জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  • ৫. দুধ দোহনের আগে গাভীর ওলান ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
  • ৬. ওলানের সম্পূর্ণ দুধ দোহন শেষে ওলান ধুইয়ে কাপড় দিয়ে মুছিয়ে ওলানের প্রতিটি বাটে ও বাটের অগ্রভাগে জীবাণুনাশক যেমন Povidon লাগিয়ে দিতে হবে।
  • ৭. সপ্তাহে কমপক্ষে ২ বার গোয়াল বা খামার জীবাণুনাশক স্প্রে যেমন FAM 30 পানিতে মিশিয়ে সমস্ত গোয়াল স্প্রে করে দিতে হবে।
  • ৮. গরুর খাবার পাত্র নিয়মিত জীবাণুনাশ স্প্রে যেমন FAM 30 এর সাথে পানি মিশিয়ে পরিষ্কার করে পরে শুধু পানি দিয়ে ধুইয়ে দিতে হবে।
  • ৯. গাভীকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে এবং নিয়মিত কমপক্ষে দিনে দুই বার গোয়াল থেকে গোবর ও চুনা পরিষ্কার করতে হবে।
  • ১০. বাচ্চা বা বাছুর প্রস্রাবের সম্ভাব্য দিনের ১০ দিন আগে থেকে বাছুর জন্মানোর ১০ দিন পর পর্যন্ত ম্যাস্টাইটিস প্রতিরোধে Masticare Plus পাওডার প্রতিদিন দিনে ১ বার করে ওষুধের গায়ে থাকা নির্দেশ মতো খাওয়াতে হবে।
  • ১১. দুধ দেওয়া কালীন প্রতি মাসে কমপক্ষে ৩ দিন Masticare Plus লেবেলে লেখা নির্দেশ মতো গাভীকে খাওয়াতে হবে।
  • ১২. গাভীর ওলানের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে, ওলান ও বাটে যাতে আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।



উপরোক্ত চিকিৎসা ও ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আশা করা যায় গাভীর ম্যাস্টাইটিস বা ওলান প্রদাহ রোগ নিরাময় করা সম্ভব হবে। এটা মনে রাখতে হবে গাভীর ওলান প্রদাহ রোগ মারাত্মক রূপ ধারন করলে গাভী চিরদিনের মতো ওলানে সমস্যা জনিত কারণে দুধ উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। ম্যাস্টাইটিস চিকিৎসা করতে বিলম্ব হলে গাভীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ওলান প্রদাহ একটি ছোয়াচে রোগ তাই রোগাক্রান্ত গরুকে পাল থেকে আলাদা না করলে পালের সকল দুগ্ধবতী গাভী এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দুধ উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। এটা মনে রাখতে হবে যে, যে কোনো রোগ নিরাময়ে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ এক অতি উত্তম পদ্ধতি।

4 comments

আমার গরুর ওলান শক্ত হয়ে গেছে, আমি কি ডাক্তার পরামর্শ নিবো

ওলান শক্ত হওয়া গরুর মারাত্মক একটি রোগ। এ জন্য আপনি এখানে দেওয়া চিকিৎসা নিজে নিজেই করতে পারেন। এতে আশা করা যায় গরু সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে যে কোনো চিকিৎসা ডাক্তারের পরামর্শ মতে করা উত্তম।


1timeschool.com এর পক্ষে,
রোদেলা

আমাদের গরুর বাটে ঘা হয়েছিলো এখন ঘাঁ কমে গেছে কিন্তু দুধ বের হবার রাস্তা চিকন হয়েগেছে এখন কি করবো

আপনি দ্রুত স্থানীয় উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে যোগাযোগ করুন। আশাকরি উপকৃত হবেন।

নিচের বক্সে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট আমাদের নিকট খুবি গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার কমেন্টের উত্তর আমরা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে চেষ্টা করবো। আমাদের সাথেই থাকুন।
1timeschool.com
EmoticonEmoticon