সোমবার

গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়ম

গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়ম ও পদ্ধতি


এখানে যা থাকছে---

  • গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়ম
  • গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর পদ্ধতি
  • গরুকে কেন ইউরিয়া খাওয়ানো হয়
  • গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর উপকারিতা

গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়ম, গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর পদ্ধতি, গরুকে কেন ইউরিয়া খাওয়ানো হয়, গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর উপকারিতা
গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়ম


ইউরিয়া কিঃ

ইউরিয়ার প্রধান উপাদান নাইট্রজেন গ্যাস। ইউরিয়ার প্রধান উপাদান প্রক্রিয়াজাত নাইট্রজেন গ্যাস। মূলত ইউরিয়া উত্তাপে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন করে। অ্যামোনিয়া ও সায়ানিক গ্যাসের সমন্বয়ে তৈরি হয় ইউরিয়া। প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উপাদান এমনিয়া হওয়ায় পৃথিবীর অনেক দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে ইউরিয়া (Urea) বা ইউরিয়া সার উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে এমনিয়া গ্যাসের অন্যতম উৎস ইউরিয়া বলে এটি প্রাণী দেহে প্রবেশের পর অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন করে। অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রতিটি অণুতে একটি  নাইট্রজেন পরমাণু এবং দুটি হাইড্রজেন পরমাণু থাকে। তাই ইউরিয়া সারকে অনেকে নাইট্রজেন সার বলেও অভিহিত করে থাকে।



গরুকে কেন ইউরিয়া খাওয়ানো হয়ঃ

মানুষের পরিপাকতন্ত্র এবং গরুর পরিপাকতন্ত্র এক নয়। সকল জাবরকাটা প্রাণীর পরিপাকতন্ত্র ৪টি প্রকোষ্ঠে বা ভাগে বিভক্ত। গরুর পেটে গাস, লতা পাতা, খড় প্রবেশের পর তা থেকে প্রটিন উৎপন্ন হয়। প্রটিন ভেঙ্গে উৎপন্ন হয় নাইট্রজেন। অপার দিকে নাইট্রজেন ভেঙ্গে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়ে গরুর শরীরে আমিষের সরবরাহ ঘটে। অর্থাৎ গরুর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন আমিষ। আমিষ তৈরীর জন্য প্রয়োজন অ্যামোনিয়া। আর অ্যামোনিয়া উৎপন্নের জন্য প্রয়োজন ইউরিয়া। অন্যদিকে ইউরিয়া সারে প্রচুর পরিমাণে গরুর আমিষের উৎস এমনিয়া বিদ্যামান থাকে। তাই কৃত্তিম উপায়ে গরুকে ইউরিয়া সার খাওয়ালে গরুর আমিষের ঘাটতি পূরণ হয় ফলে গরু দ্রুত বেড়ে ওঠে। ইউরিয়া সারে ২৪৫% গরুর প্রয়োজনীয় ক্রুড আমিষ বিদ্যামান। তাই আমিষের সরবরাহ নিশ্চিত করে দ্রুত মাংস ও দুধ উৎপাদনের জন্য গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো হয়।



গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়মঃ

গরুর দেহে প্রতিদিন স্বাভাবিক ভাবে ২০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োজন। গরুর দেহে এর চেয়ে কম ইউরিয়া উৎপন্ন হলে গরু শুকিয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে কৃত্তিম উপায়ে ইউরিয়া সরবরাহ করলে ২০ গ্রামের চেয়ে বেশি ইউরিয়া খাওয়ালে বেশি আমিষ পেয়ে গরু দ্রুত মোটা হতে থাকে। কিন্তু ইউরিয়া থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়। ফলে বেশি পরিমাণে ইউরিয়া খাওয়ালে বেশি পরিমাণে অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়। অধিক গ্যাসের চাপে করুর বদ হজম শুরু হতে পারে। এছাড়া অধিক পরিমাণে অ্যামোনিয়া গ্যাসের চাপে গরুর পেট ফেপে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই ওজন ও বয়স ভেদে গরুকে ২০ গ্রাম বা তার চেয়ে সামান্য পরিমাণ বেশি ইউরিয়া প্রতিদিন সরবরাহ করা উত্তম। ৬ মাস বয়সের আগে গরু পূর্ণ মাত্রায় জাবর কাটা শেখে না। তাই ৬ মাস বয়সের চেয়ে ছোট গরুকে ইউরিয়া সার খাওয়ানো কখনোই ঠিক নয়।



গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর পদ্ধতিঃ

গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো উত্তম। কিন্তু গরকে কি ভাবে ইউরিয়া খাওয়াতে হবে সে সম্পর্কে ধারনা ছাড়া গরুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। নিম্নে গরুকে ইউরিয়া সার খাওয়ানোর আধুনিক ও প্রচলিত ৩ টি পদ্ধতি তুলে ধরা হল। পদ্ধতি গুলো হল-

  • ১. ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র বা ইউএমএস (UMS) পদ্ধতি
  • ২. ইউরিয়া মোলাসেস মাল্টি মিনারেল ব্লক বা ইউএমএমবি (UMMB) পদ্ধতি
  • ৩. সরাসরি খাদ্যের সাথে ইউরিয়া খাওয়ানোর পদ্ধতি



ইউরিয়া মোলাসেস স্ট্র তৈরির নিয়ম ও গরুকে খাওয়ানোর পদ্ধতিঃ

গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর অন্যতম পদ্ধতি হিসেবে ইউএমএস পদ্ধতি খুবি জনপ্রিয়। ইউএমএস বা UMS এর পূর্ণ রূপ হল Urea Molasses Straw. এখানে Urea বলতে ইউরিয়া সার কে বোঝানো হয়েছে, Molasses অর্থ চিটাগুড় এবং Straw অর্থ খড় বা পল। সুতারং ইউরিয়া মোলাসিস স্ট্র বলতে ইউরিয়া এবং চিটাগুড় মিশ্রিত খড়কে বোঝানো হয়ে থাকে। ইউএমএস পদ্ধতিতে খড়ের সাথে ইউরিয়া ও গুড় মেশাতে পানি বা জল যোগ করতে হয়। শুধু মেশালেই হবে না। ইউএমএস তৈরী করতে চিটাগুড়, ইউরিয়া ও চিটাগুড়ের পরিমাণ সবসময় ঠিক রাখতে হয়। নইলে সঠিক ফল পাওয়া যায় না। ইউরিয়া মোলাসিস স্ট্র তৈরি করতে ৮২ কেজি খড়ের সাথে ১৫ কেজি চিটাগুড়, ৩০ কেজি পানি এবং ৩ কেজি ইউরিয়া মেশাতে হবে। চিটাগুড় বেশি ঘণ হলে পানির পরিমাণ বাড়াতে হবে আর চিটাগুড় বেশি তরল হলে পানির পরিমাণ কমাতে হবে। অর্থাৎ ইউএমএস তৈরিতে খড়, চিটাগুড়, পানি এবং ইউরিয়ার অনুপাত হবে ৮২:১৫:৩০:৩ পরিমাণ অথবা ১০ কেজি খড়ে ২.৫ কেজি চিটাগুড়, ৫ কেজি পানি এবং ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া মেশালেও হবে। কুচিকুচি করে কাটা শুকনো খড়ে পানি মিশ্রিত চিটাগুড় এবং ইউরিয়া ভালো করে মেশালেই তৈরি হয়ে যাবে ইউএমএস বা ইউরিয়া মোলাসিস স্ট্র। ইউএমএস তৈরি করে সংগে সংগে গরুকে খাওয়ানো যায় আবার সংরক্ষণ করেও খাওয়ানো যায়। তবে তৈরির পর সর্বোচ্চ ৩ দিনের বেশি সংরক্ষণ করে খাওয়ানো যাবে না। ইউএমএস বা ইউরিয়া মোলাসিস স্ট্র নিয়ে বিস্তারিত তথ্য আমরা দ্রুত লিখবো। আশাকরি আমাদের সাথেই থাকবেন। ইউ এম এস গরুকে ইচ্ছামত ও গরুর চাহিদা মত ৬ মাসের বড় সকল গরুকে নিয়মিত খাওয়ানো যায়।



ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক তৈরির নিয়ম ও গরুকে খাওয়ানোর পদ্ধতিঃ

ইউরিয়া মোলাসিস মিনারেল ব্লক পদ্ধতিতে গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো খুবি সোজা। প্রথমে ইউএমএমবি (UMMB) তৈরি করে নিতে হবে। ইউএমএমবি বা ইউরিয়া মোলাসেস মিনারেল ব্লক তৈরির জন্য ৩ কেজি পরিমাণ গমের ভূষি নিতে হবে। চিটাগুড় বা মোলাসিস নিতে হবে ৬ কেজি। ৩৫ গ্রাম লবণ, ৫০০ গ্রাম খাবার চুন এবং ৯০ গ্রাম ইউরিয়া নিতে হবে। সমস্ত পরিমাণ জিনিস একসাথে ভালো করে মিশিয়ে কাদা কাদা করে নিতে হবে। এবার কাঠের ফ্রেমে বা লোহার ফ্রেমে অথবা পলেথিনের উপর চারটি ইট দিয়ে ফ্রেম তৈরি করে তার মাঝে মিশ্রণ ঢেলে দিতে হবে। অর্থাৎ কাচা ইট যে ভাবে ফ্রেমে বানায় সেভাবে UMMB বানাতে হবে। এই মিশ্রণ ফ্রেমে করে রোদে শুকালে শক্ত হলে অনেক দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এটি শক্ত ইট আকারে বা ফ্রেম আকারে তৈরি করা হয় বলে একে ব্লক বা মোলাসিস ইউরিয়া দিয়ে তৈরি ইট বলে। UMMB তৈরির পর প্রতি গরুকে প্রতিদিন ৪০-৫০ গ্রাম করে খেতে দিতে হবে। অভ্যাস হয়ে গেলে প্রতিটি গরু মজা করে চেটে চেটে ইউএমএমবি তৃপ্তি সহকারে খাবে।



গরুকে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ানোর নিয়মঃ

গরুকে সরাসরি ইউরিয়া খাওয়ানোর জন্য প্রথম কাজ হল গরুকে ধীরেধীরে ইউরিয়া খেতে অভ্যস্ত করে তোলা। এজন্য প্রথমে ৫ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০০ গ্রাম মোলাসিস বা চিটাগুড় ১.৫-২ লিটার পানির সাথে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। এবার উক্ত মিশ্রণ কুচি করে কাটা ৪-৫ কেজি খড়ের সাথে এমন ভাবে মেশাতে হবে যেন সমস্ত তরল খড়ের সাথে ভালো করে মিশে যায়। উক্ত খড় সরাসরি গরুকে এক দিনে খাইয়ে ফেলতে হবে। এভাবে ১৫ দিন খাওয়াতে হবে। ১৫ দিন পর সকল উপাদান ঠিক থাকবে কিন্তু ইউরিয়া ৫ গ্রামের পরিবর্তে ১০ গ্রাম বা ২ চা চামচ দিতে হবে। এভাবে আরো ১৫ দিন খাওয়াতে হবে। ১৫ দিন পর সকল উপাদান ঠিক রেখে ইউরিয়া ২ চা চামচের পরিবর্তে ৩ চা চামচ বা ১৫ গ্রাম দিতে হবে। এভাবে ১৫ দিন খাওয়াতে হবে। এর পর আবার সব উপাদান ঠিক রেখে ইউরিয়া ৩ চা চামচের পরিবর্তে ৪ চা চামচ বা ২০ গ্রাম দিতে হবে। এই ভাবে গরুকে খাইয়ে যেতে হবে। প্রতিদিন ৪ চা চামচ বা ২০ গ্রামের বেশি ইউরিয়া কখনো সরাসরি পদ্ধতিতে গরুকে খাওয়ানো যাবে না। এভাবে খাওয়ালে ৪-৫ মাসে গরু মোটাতাজা হয়ে উঠবে। সরাসরি পদ্ধতিতে ইউরিয়া খাওয়ানো সহজ ও ঝামেলা মুক্ত। তাই এই পদ্ধতি দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।



গরুকে ইউরিয়া খাওয়াতে সতর্কতাঃ

গরকে ইউরিয়া খাওয়াতে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। ইউরিয়া খাওয়াতে যে সকল সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত তা নিম্নরূপ-

  • ১. ৬ মাসের কম বয়সী গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো ঠিক নয়।
  • ২. প্রতিদিন ২০ গ্রামের বেশি ইউরিয়া খাওয়ানো ঠিক নয় তবে জাত ও ওজন ভেদে এই মাত্রা কম বেশি হতে পারে।
  • ৩. দ্রুত মোটা করার আশায় গরুকে বেশি মাত্রায় ইউরিয়া খাওয়ালে বেশি মাত্রায় অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপন্ন হয়ে গরু মারা যেতে পারে।
  • ৪. ধীরেধীরে গরুকে ইউরিয়া মিশ্রিত খড়ে অভ্যস্ত করে তোলা উচিত, হঠাৎ বেশি পরিমাণে খাওয়ালে বদ হজম হয়ে গরু মারা যেতে পারে।
  • ৫. ইউরিয়া মিশ্রিত খড় খাওয়ার পরপরি পানি না খাইয়ে ৩০-৪০ মিনিট পর পানি খাওয়াতে হবে যাতে বদহজম কম হয়।
  • ৬. ইউরিয়া মিশ্রিত খড় কখনো পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যাবে না বরং শুষ্ক শুষ্ক অবস্থায় খাওয়ানো উত্তম।
  • ৭. গর্ভবতী গরুর গর্ভের শেষদিকে ইউরিয়া খাওয়ানো উচিৎ নয় অর্থাৎ বাচ্চা প্রস্রবের ২ মাস আগ ইউরিয়া খাওয়ানো বন্ধ করতে হবে।



গরুকে উইরিয়া খাওয়ানোর উপকারিতাঃ

গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর প্রয়োজনিয়তা বা উপকারিতা অপরিসীম। গরুকে নিয়মিত ইউরিয়া খাওয়ানোর ফলে গরুর আমিষের অভাব দূর হয়। ফলে দ্রুত মাংস ও দুধ উৎপাদন বাড়তে থাকে। আধুনিক নিয়মে বানিজ্যিক ভাবে ফার্ম করে লাভবান হতে গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ইউরিয়া খাওয়ানোর ফলে গরুর খাদ্য হজম প্রক্রিয়া বেশি হয়, গরুর খাদ্য চাহিদা বাড়ে এবং দ্রুত বেড়ে ওঠে। গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো কোনো ক্ষতিকার ব্যপার নয় বরং দেশের মাংস ও দুধের চাহিদা মেটাতে সকল গরুকে ইউরিয়া খাওয়ানো উচিত। ইউরিয়া দামে সস্থা, মোলাসেস বা চিটাগুড়ের দামো অনেক কম। স্বল্প খরচে গরু থেকে বেশি মুনাফা পেতে ইউরিয়া খাওয়ানো অত্যাবশ্যক একটি উপায়।

নিচের বক্সে কমেন্ট করুন। আপনার প্রতিটি কমেন্ট আমাদের নিকট খুবি গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার কমেন্টের উত্তর আমরা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে চেষ্টা করবো। আমাদের সাথেই থাকুন।
1timeschool.com
EmoticonEmoticon